– ‘আচ্ছা সাজিদ, সৃষ্টিকর্তা কি দয়ালু নাকি পাষাণ?’- দেবজিৎ দা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সাজিদকে জিজ্ঞেস করলো।
আমার পাশে বসা ছিলো মিজবাহ। সে বললো, ‘অদ্ভুত তো! সৃষ্টিকর্তা পাষাণ হবেন কেনো? উনি হলেন রাহমানুর রহিম। পরম দয়ালু।’
দেবজিৎ দা মিজবাহর দিকে তাকালেন। এরপরে বললেন, ‘মিজবাহ, সৃষ্টিকর্তা যদি পরম দয়ালুই হবেন, তাহলে তিনি তার সৃষ্টিকে শাস্তি দেওয়ার জন্য কেনো নরক, আই মিন জাহান্নামের মতো জিনিস বানিয়ে রেখেছেন?’
মিজবাহর চটপটে উত্তর, ‘এটা কোন প্রশ্ন হলো দাদা? কেউ যদি সৃষ্টিকর্তার কমান্ড ফলো না করে,তাহলে তাকে যদি শাস্তি দেওয়া হয়, সেটা কোনভাবেই সৃষ্টিকর্তাকে পাষাণ প্রমাণ করে না।’
মিজবাহর এই উত্তর দেবজিৎ দা’কে সন্তুষ্ট করেছে বলে মনে হচ্ছে না। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করতে যাবেন, ঠিক এই সময় সাজিদ বলে উঠলো, ‘দাদা, আজকের পত্রিকা পড়েছো?’
দেবজিৎ দা বললেন, ‘না। কেনো?’
– ‘একটা নিউজ আছে।’
– ‘কি নিউজ?’
সাজিদ দেবজিৎ দা’র দিকে পত্রিকাটা এগিয়ে দিলো। পত্রিকার একদম প্রথম পাতায় বড় বড় অক্ষরে শিরোনাম– ‘সোনাগাজীতে ৯ বছরের বালিকাকে ৫ জন মিলে গ্যাং রেপ।’
বিস্তারিত অংশে যা লিখা আছে তার সারমর্ম এরকম–
‘নোয়াখালীর সোনাগাজীতে ৯ বছরের এক বালিকাকে স্কুল থেকে ফেরার পথে ৫ জন যুবক মিলে ধর্ষণ করেছে। ধর্ষণের পর তারা মেয়েটিকে আহত অবস্থায় ধান ক্ষেতে ফেলে যায়। মেয়েটিকে খুব গুরুতর অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। শুধুই ধর্ষণ নয়, মেয়েটির শরীরের বিভিন্ন অংশ ব্লেড দিয়ে কাটাও হয়েছে। প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হয়েছে। মেয়েটি এখন পুরোটাই কোমার মধ্যে আছে। ধর্ষণকারীদের গ্রামের লোকজন আটক করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেছে।জানা গেছে, মেয়ের বাবা এলাকার মেম্বার। মেম্বারের উপর সালিশ বিষয়ক কোন এক ব্যাপারে ক্ষোভ থেকেই উনার মেয়ের উপরে এই নির্যাতন চালায় ওরা।’
ঘটনাটা গতকালের। পত্রিকায় ছোট্ট মেয়েটির একটি ছবিও দেওয়া আছে। কি ফুটফুটে চেহারা।
দেবজিৎ দা নরম মনের মানুষ। এরকম একটি খবর পড়ার পরে উনার মনটা মুহূর্তেই বিষণ্ণতায় ছেঁয়ে গেলো। দাঁতে দাঁত খিচে অনেকক্ষণ অই ৫ জন ধর্ষণকারীদের গালাগাল দিলেন।
সাজিদ পত্রিকাটা ব্যাগে রাখতে রাখতে বললো, ‘দাদা, ধরো, এই ৫ জনকে কোর্টে তোলা হলো আর তুমি হলে বিচারক। এই ৫ জন যে আসল অপরাধী তার সমস্ত রকম তথ্য–প্রমাণ তোমার কাছে পেশ করা হয়েছে। এখন একজন নাবালিকার উপরে এরকম নির্মমভাবে নির্যাতন করার জন্য তুমি কি তাদের শাস্তি দিবে?’
দেবজিৎ দা দাঁত মুখ খিচে বললেন, ‘শাস্তি দিবো মানে? শুয়োরের বাচ্চাগুলোকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবো।’
সাজিদ মুচকি হাসলো। বললো, ‘সত্যিই তাই?’
– ‘হ্যাঁ, একদম। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এদের মাংশ শেয়াল–কুকুর দিয়ে খাওয়াতে পারলেই আমার গা জুড়োবে।’
দেবজিৎ দা’র চোখ মুখ লালবর্ণ ধারণ করেছে। উনাকে এরকম অবস্থায় আগে কখনো দেখি নি।
সাজিদ এক গ্লাস পানি উনার দিকে বাড়িয়ে দিলো। পানিটা ঢকঢক করে পান করে উনি শার্টের হাতাতে মুখ মুছলেন। উনি তখনও প্রচন্ড রেগে আছেন বোঝা যাচ্ছে।
সাজিদ বললো, ‘আমি যে দেবজিৎ দাদাকে চিনি, সে কিন্তু এতোটা হিংস্র না। আমি তাকে জানতাম দয়ালু, ক্ষমাশীল, মহানুভব হিসেবে। সে যে কাউকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবার কথাও ভাবতে পারে, সেটাই বিরাট আশ্চর্য লাগছে।’
দেবজিৎ দা সাজিদের দিকে তাকালেন।তাকানোতে একটা তাচ্ছিল্যতা আছে।
বললেন, ‘শোন সাজিদ, আমি দয়ালু,মহানুভব ঠিক আছে। কিন্তু তার মানে এই না যে আমি কোন অন্যায় দেখে চুপ করে থাকবো। আমার ক্যারেক্টারের ক্রাইটেরিয়াতে যেমন দয়ালু, মহান,উদার এসব আছে, ঠিক তেমনি আমি ন্যায়বিচারকও। অন্যায়ের কোন প্রশ্রয় আমার কাছে নেই।’
– ‘বিচারক হিসেবে তুমি চাইলেই অই ৫ জন অপরাধীকে ক্ষমা করে দিতেই পারো।’– সাজিদ বললো।
– ‘হ্যাঁ পারি। কিন্তু তাহলে যে অই নিষ্পাপ মেয়েটার সাথেই অন্যায় করা হবে। অবিচার করা হবে। আমি সেটা পারবো না।’
– ‘তাহলে কি ধরে নেবো যে তুমি পাষাণ? কঠিন হৃদয়ের? তোমার মাঝে কোন ভালোবাসা নেই, মমতা নেই?’
দেবজিৎ দা উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, ‘আশ্চর্য! তোর বুদ্ধিসুদ্ধি কি সব লোপ পেয়েছে রে সাজিদ? ৫ জন লোক ঘোরতর অন্যায় করেছে। তাদের অন্যায়ের জন্য আমি তাদের শাস্তি দিবো এটাই স্বাভাবিক। একজন বিচারক হিসেবে এখানে ন্যায়ের পক্ষ নেওয়াই আমার ধর্ম, আমার প্রেম, আমার ভালোবাসা। এটা কি প্রমাণ করে যে আমি পাষাণ?’
সাজিদ আবার মুচকি হাসলো। বললো, ‘দাদা, তোমাকে উত্তেজিত করার জন্য দুঃখিত। না, তুমি আসলেই খুব ভালো।
সৃষ্টিকর্তা যেমন পরম দয়ালু, ক্ষমাশীল, ঠিক তেমনি তিনি আবার একজন ন্যায় বিচারকও। তিনি কারো সাথে বিন্দু পরিমাণও অন্যায় হতে দেন না। সৃষ্টিকর্তা আমাদের সবাইকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি আমাদের জন্য কিছু নির্দিষ্ট রুলস তৈরি করে দিয়েছেন। এখন কিছু লোক এই রুলস ফলো করে যদি তার দেওয়া বিধান মতো জীবনযাপন করে, তাদের তিনি পুরষ্কার হিসেবে জান্নাত দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। এখন একদল লোক নামাজ–কালাম পড়ে, মিথ্যে কথা বলে না, লোক ঠকায় না, চুরি রাহাজানি করেনা, সুদ–ঘুষ খায়না, মানুষ খুন করেনা, মোদ্দাকথা, সকল প্রকার অন্যায় থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখে কেবল স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ এবং তাঁর প্রতিশ্রুত জান্নাতের জন্য।
অপরদিকে আরেকদল লোক এসবের থোড়াই কেয়ার করে যদি ভোগ বিলাসে মেতে উঠে, সকল অন্যায় কাজ করে, স্রষ্টার অবাধ্য হয়, তাহলে স্রষ্টা যদি দয়াপরবশ হয়ে তাদেরকে আগের দলের সাথে জান্নাতে পাঠিয়ে দেয়, তাহলে এটা কি ন্যায় হলো? প্রথম দলকে তো ঠকানো হলোই, সাথে কি পরের দলের সকল অন্যায়কে মেনে নেওয়া হলো না? প্রশ্রয় দেওয়া হলো না? তুমি যেভাবে বিচারকের আসনে বসে ক্ষমতা থাকার পরও অই ৫ জনকে ক্ষমা করে দিতে পারো না কেবল ন্যায় প্রতিষ্টার জন্য, স্রষ্টাও কি সেটা পারেন না?’
দেবজিৎ দা কিছু বললেন না। সাজিদ আবার বললো, ‘এটা হলো স্রষ্টার ক্রাইটেরিয়া। তিনি যেমন পরম দয়ালু, ঠিক সেরকম ন্যায় বিচারকও।
আরেকটু ক্লিয়ার করি। ধরো, একজন বাবার দুটি সন্তান। দুই সন্তানের প্রথমজন দ্বিতীয়জনকে বিনা কারণেই ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলো। যাকে ধাক্কা দিলো সে মাটিতে পড়ে খুব ব্যথা পেলো এবং চিৎকার করে কেঁদে উঠলো।
এখন বাবা এসে যদি প্রথমজনকে তার অন্যায়ের জন্য কোন শাস্তি না দেয়, তাহলে সেটা তার দ্বিতীয় সন্তান, যে নিষ্পাপ,তার প্রতি কি অন্যায় করা হবে না?’
– ‘হু’– দেবজিৎ দা বললেন।
– ‘স্রষ্টা এরকম নন। এইজন্যই তিনি জান্নাত আর জাহান্নাম দুটোই তৈরি করে রেখেছেন। আমাদের কর্মফলই নির্ধারণ করে দেবে আমাদের গন্তব্যস্থল। এতে কোন দুই নাম্বারি হবে না।কারো সাথে চুল পরিমাণও অন্যায় হবে না।’
দেবজিৎ দা বললেন, ‘তা বুঝলাম। কিন্তু তিনি যেহেতু স্রষ্টা, তিনি আমাদের চেয়ে হাজারগুণ দয়ালু হবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই তিনিই আবার আমাদের কর্ম পরিচালনা করছেন আবার তিনিই আমাদের ধরে ধরে জাহান্নামে পাঠাচ্ছেন। ব্যাপারটা কেমন না সাজিদ?’
সাজিদ বললো, ‘দাদা, প্রথমত, স্রষ্টা আমাদের কর্ম পরিচালনা করেন না। স্রষ্টা আমাদের একটা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। সাথে পাঠিয়েছেন একটা গাইডবুক।এখন এই স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করেই আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে আমরা কি তাঁর দেখানো পথে চলবো কি চলবো না। যদি চলি, আমরা জান্নাতে যাবো। যদি না চলি, আমরা জাহান্নামে যাবো। মোদ্দাকথা, আমরা কোথায় যাবো তা আমরাই নির্ধারণ করি আমাদের কর্মের মাধ্যমে।’
দেবজিৎ দা হাসলেন। বললেন, ‘ও আচ্ছা। তার মানে তুই বলতে চাচ্ছিস যে কিছু লোক স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে জাহান্নাম চুস করে নিচ্ছে?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘উদ্ভট না কথাটা?’
– ‘একদম না।’
– ‘লজিক্যালি বল।’
– ‘আচ্ছা। ধরো, তুমি গভীর সাগরে জাহাজ থেকে পানিতে পড়ে গেলে। পানিতে তুমি হাঁশপাস করছো।একটু পরেই অতল তলে তলিয়ে যাবে। এখন ধরো, তোমাকে উদ্ধার করার জন্য আমি একটি লাইফ জ্যাকেট তোমার দিকে বাড়িয়ে দিলাম।’
– ‘হু,তো?’
– ‘সেই মূহুর্তে তোমার কাছে দুটি অপশান। হয় লাইফ জ্যাকেটটি নিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাবে নয়তো, আমাকে ডিনাই করবে আর অতল সাগরে তলিয়ে যাবে এবং মৃত্যুবরণ করবে।
খেয়াল করো, আমি কিন্তু বাঁচার উপকরণ,অর্থাৎ লাইফ জ্যাকেট তোমার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছি। এখন তুমি তোমার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে জ্যাকেটটি গ্রহণ করে প্রাণে বাঁচবে নাকি ডিনাই করে মৃত্যুকে বরণ করবে সেটা সম্পূর্ণ তোমার ব্যাপার। স্রষ্টাও জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপকরণ আমাদের জন্য পাঠিয়েছেন। সাথে আমাদের ফ্রি উইল দিয়ে দিয়েছেন।এখন, আমরা তা আঁকড়ে ধরে বাঁচবো নাকি উপেক্ষা করে মরবো তা আমাদের উপর নির্ভর করছে।’
দেবজিৎ দা কিছু বললেন না। স্রষ্টা দয়ালু হয়েও কেনো জাহান্নাম তৈরি করেছেন তার উত্তর তিনি মনে হয় পেয়ে গেছেন। চায়ের বিল পরিশোধ করে এসে দেবজিৎ দা বললেন, ‘স্রষ্টা যেহেতু আমাদের চেয়ে অনেক বেশি দয়ালু, তিনি কিন্তু চাইলেই পারেন ক্ষমা করে দিতে।’
সাজিদ বললো, ‘স্রষ্টা শুধু তোমার চেয়ে অনেক বেশি দয়ালুই নন, তোমার চেয়ে অনেক বেশি ন্যায়বিচারকও। সুতরাং……’
সাজিদকে আর কিছুই বলতে দিলেন না দেবজিৎ দা। মনমরা করে বললেন, ‘বুঝেছি।’
সাজিদ হাসলো। দেবজিৎ দা’র এই চাহনি দেখে আমাদেরও হাসি পেলো। আমরাও হাসলাম। আমাদের হাসতে দেখে তিনিও আমাদের সাথে হাসা শুরু করলেন। হা হা হা।
এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান
Comments 0